রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০১:৫৩ পূর্বাহ্ন
রাহাত মিনহাজ:
পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র ধারণার সূচনা হয়েছিল লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে। বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। এরপর এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার জনগণ সামনের সারি থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। লক্ষ্য ছিল শোষণের অবসান আর ইসলামি ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা।
স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ ছিলেন একজন আইজীবী। যার ছুড়ি-কাঁচিতেই ১৯৪৭ সালে কাটাছেঁড়া হয় ভারতবর্ষ। এতে ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান নামের যে রাষ্ট্রের জন্ম হয় তার আকৃতি হলো অস্বাভাবিক, বিকৃত অনেকটা কিম্ভূতকিমাকার।
পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড থেকে এর দূরত্ব ১২শ মাইলের বেশি। মিল নেই ভাষা, সংস্কৃতি এমনকি খাদ্যাভ্যাসে। মিল শুধু একটাই তা হলো ধর্ম। ধর্মের ভিত্তিতে আধুনিক রাষ্ট্র গঠন নিয়ে ওই সময়ই আলোচনা উঠেছিল। ভারত ভাগ চূড়ান্ত হলে সবশেষ বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে বলেছিলেন, পাকিস্তান হবে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র যা ২৫ বছরের বেশি টিকেবে না। পরিতাপের বিষয় এই যে কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টিতে পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক ভূমিকা অগ্রগণ্য হলেও পূর্ব বাংলার মানুষ শুরু থেকেই নতুন এই রাষ্ট্রে মারাত্মক বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। শুরুতেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল বাঙালি মুসলমানদের।
নতুন ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানে পাঞ্জাবি শাসক গোষ্ঠীর সীমাহীন দৈরাত্ম্য শুরু হয়। সবকিছুই তাদের হাতে। দেশটির প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদ-এ-আজম (প্রধান নেতা) মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর পাকিস্তানে শাসক শ্রেণির প্রায় সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। মন্ত্রীরা পশ্চিম পাকিস্তানি, আমলারা পশ্চিমা। আর সেনাবাহিনী পুরোটাই তাদের দখলে। দেখা গেল, আগে বাঙালিদের শাসক ছিল ব্রিটিশরা আর স্বাধীনতার পর সেখানে প্রতিস্থাপিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা, মূলত পাঞ্জাবি অভিজাতরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যাসহ অন্যান্য সুবিধা থাকলেও পাকিস্তানের রাজধানী হয়েছিল করাচি। ঢাকা থাকল অবহেলায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় দেশটির কায়েদ-ই-আজম বা প্রধান নেতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। জিন্নাহ জানতেন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যে দেশ তিনি পেয়েছেন তার ভিত্তি বেশ দুর্বল। ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেশটির অবস্থা ভঙ্গুর। তাই দেশটির প্রথম গভর্নর জেনারেল হয়ে দ্রুত দুই পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন জিন্নাহ। তবে তিনি ভুল পথে হেঁটেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের চাওয়া ছিল ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে সাম্য ও মর্যাদাভিত্তিক একটি রাষ্ট্র। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিমের আকাশ-পাতাল অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য কমানোর বদলে জিন্নাহ বেছে নিয়েছিলেন ধর্মকে। আর তাই তার দাবি অনুযায়ী ইসলাম ধর্মের ভাষা, পবিত্র ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রচলনের চেষ্টা করেন। ক্রমাগত বৈষম্যমূলক আচরণের মধ্যে সবার আগে সামনে আসে ভাষার প্রশ্ন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম দুর্বলতা ছিল দেশটির দুই অংশের মানুষের প্রধান ভাষা এক ছিল না। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ ছিল। যেগুলোর প্রত্যেকটির ভাষা আলাদা। পাঞ্জাবে পাঞ্জাবি, সিন্ধুতে সিন্ধি, বেলুচিস্তানের বেলুচি আর সীমান্ত প্রদেশগুলোর ভাষা পশতু। এই প্রদেশগুলোতে কিছু মানুষের ভাষা ছিল উর্দু। তবে এই চারটি ভাষার হরফ ছিল এক। অর্থাৎ লেখা হতো উর্দু হরফে।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫ কোটি। যাদের মধ্যে ৪ কোটির বেশি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া পুরো পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষা বাংলা। বর্ণমালাও সম্পূর্ণ আলাদা। ভাষাগত ভিন্নতার এই দুর্বলতা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভালো করেই জানত। তাই তারা ধর্মের সঙ্গে ভাষাগত ঐক্য স্থাপনের কৌশল নিয়ে নতুন এক প্রকল্প শুরু করে। শুরু হলো তাদের মতে ইসলামের ভাষা, পবিত্র ভাষা উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। তারা মনে করত উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা গেলেই দু’অংশের মধ্যে অটুট বন্ধন বজায় রাখা সম্ভব। পাকিস্তান রাষ্ট্রে নৃ-তাত্ত্বিকভাবে কারও মুখের ভাষা উর্দু ছিল না। এটা কৃত্রিম ভাষা। আরোপিত ভাষা। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, উর্দু একটি তুর্কি শব্দ, যার অর্থ সৈন্য। এটি ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবর্গের অন্তর্ভুক্ত ইন্দো-ইরানি উপগোত্রের একটি ভাষা। দিল্লির আশপাশে যে পশ্চিমা হিন্দি ভাষা প্রচলিত ছিল উর্দু ছিল তারই একটি শাখা। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের আগমনের ফলে ফারসি ভাষার শব্দের প্রচলন হয়েছিল। এই ফারসি শব্দের সংমিশ্রণে উর্দু ভাষার জন্ম হয়। এটি কোনো অবস্থাতেই ভারতবর্ষের মানুষের আদি ভাষা ছিল না। আর এই অপরিচিত ভাষা প্রচলনে পূর্ব বাংলায় জিন্নাহর সহযোগী ছিল মুসলিম লিগ নেতারা। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাঙালি প্রধানমন্ত্রী করাচিতে ঘোষণা করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অনুভূতি হচ্ছে উর্দুই হবে একমাত্র ভাষা। উর্দুকে বহু ভাষাভাষীর রাষ্ট্রের যোগাযোগের মাধ্যম বা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। আর এই লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কাকে চাপিয়ে দিতেই মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর নেতৃত্বে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা। অনেক বাঙালি মুসলিম যাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা তারাও ছিলেন জিন্নাহর পক্ষে। সে সময় জিন্নাহ সঙ্গে পান দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আর নুরুল আমিনকে।
তবে এটাই কাল হলো পাঞ্জাবিদের জন্য। ভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলে জ্বলে উঠল পুরো পূর্ব বাংলা। রাষ্ট্র কাঠামোয় সীমাহীন বৈষম্য আর বঞ্চনার প্রতিবাদ এসে ঠেকল ভাষার প্রশ্নে। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলার মানুষ প্রথমবারের মতো একতাবদ্ধ হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। বাংলার তরুণ-যুবা, বামপন্থি, তখনকার সময়ে অনেকটা ডানপন্থি আওয়ামী মুসলিম লীগ এক কাতারে দাঁড়াল ভাষা আন্দোলনের পক্ষে। যদিও ব্যতিক্রম ছিল খাজা নাজিমুদ্দিনের মুসলিম লীগ ও কট্টর ইসলামপন্থি কিছু দল ও ক্ষমতাশালী কিছু অভিজাত পরিবার। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, এই অভিজাত মুসলিমরা কখনই বাংলা ভাষাকে আয়ত্ত করতে পারেননি। বাংলা ভাষাকে তারা আপনও মনে করেননি। তাদের অবস্থান ছিল উর্দুর পক্ষে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির অবস্থান ছিল বাংলা ভাষার পক্ষে। এছাড়া ভাষার প্রশ্নে বাঙালিরা ছিলেন ভীষণ সংবেদনশীল। আর যে কারণেই ১৯৪৭ সালের আগস্টে নতুন দেশ পাওয়ার পরপরই ঐ বছরের ডিসেম্বরে ভাষার প্রশ্নে ঢাকায় হরতাল ডাকা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভাষার প্রশ্নে প্রথম পালিত হয় হরতাল বা কর্মবিরতি। যা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
১৯৪৭-এ দেশবিভাগের পর থেকেই ভাষার প্রশ্নে উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল পূর্ব পাকিস্তান। এমনই পরিস্থিতিতে ১৯৪৮-এর মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন উপলক্ষে ঢাকায় আসেন জিন্নাহ। ওই সফরে ঢাকাতে সব ভাষণই উর্দুতে দেন। ২১ মার্চ ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। সেই ভাষণে জিন্নাহ বলেন, ‘এটা আপনাদের স্পষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অপর কোনো ভাষা নয়। যদি আপনাদের কেউ বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে সে হবে পাকিস্তানের প্রকৃত শত্রু। একটি রাষ্ট্রভাষা ছাড়া কোনো জাতিই দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ ও টিকে থাকতে পারে না।… সুতরাং রাষ্ট্রভাষার ব্যাপরে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ ঢাকায় তার শেষ ভাষণ ছিল ২৪ মার্চ কার্জন হলে। সেখানে জিন্নাহ আবারও কড়া ভাষায় ঘোষণা দেন ‘কেবল একটিই রাষ্ট্রভাষা থাকতে পারে। যদি এক রাষ্ট্রের গঠনকারী অংশসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সে ভাষা, আমার মতে কেবল উর্দুই হতে পারে।’ এই বক্তব্যের পরপরই উপস্থিত ছাত্র জনতা প্রতিবাদ করেন। ‘নো’ ‘নো’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সভা প্রাঙ্গণ। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্রুতই এক নম্বর ইস্যুতে পরিণত হয় রাষ্ট্রভাষা বিষয়টি। এদিকে জিন্নাহর ঐ ভাষণের পরই সংগঠিত হতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। যার নেতৃত্বে ছিলেন বামপন্থি রাজনীতিবিদরা। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ভাষা অন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব শামসুল হক, আবুল কাশেম, কামরুদ্দিন আহমদ, অলি আহাদসহ অন্যরা একটি প্রতিনিধিদল গঠন করে জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করেন। তারা রাষ্ট্রভাষার যৌক্তিক দাবি তুলে ধরেন জিন্নাহর কাছে। তবে জিন্নাহ সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। আন্দোলন, গুলি, প্রাণ বিসর্জন পরবর্তী সময়ে মায়ের ভাষার অধিকার অর্জন।
যক্ষ্মারোগে ভুগে ১৯৪৮-এর ১১ সেপ্টেম্বর মারা যান বাংলা ভাষার প্রধান শত্রু মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ। তার কবরের ওপর ১৯৭০ সালে করাচিতে তৈরি হয় তার সমাধি কমপ্লেক্স। তখন তার কবরের নামফলক লেখা হয় দুটি ভাষায়। উর্দু আর বাংলা। কারণ ভাষার দাবিতে প্রাণ বিসর্জনের পর এরই মধ্যে তার পেয়ারা পাকিস্তানে বাংলা ভাষার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রক্তের অক্ষরে সাংবিধানিকভাবে গৃহীত হয়েছে বাংলার অধিকার।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ভয়েস/আআ